মানিকগঞ্জ : আজ ১৩ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস। রাজধানীর তৎকালীন নদী বন্দর মহকুমা হিসেবে মানিকগঞ্জ শত্রুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ছিল। অন্যান্য জেলা এসময় হানাদার মুক্ত হলেও মানিকগঞ্জকে শক্ররা আকড়িয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু এ জেলার মুক্তি পাগল দামাল ছেলেরা এ জনপদ থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ছিল। বিপ্লবী ছাত্র জনতা সর্বস্তুরের মানুষ মানিকগঞ্জকে মুক্ত করে এই দিনের উদিত সূর্যকে বিজয়মাল্য অভিনন্দিত করে সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস, আর সে ইতিহাস বিজয়ের ইতিহাস।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সি এন্ড বির ডাকবাংলোতে হানাদাররা তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করে ১৩ ডিসেম্বরের আগেই শক্ত অবস্থান নেয়। শহরের বাসষ্ট্যান্ড সংলগ্ন পিটিআই থেকেই পাকবাহিনী এবং তাদের দোসররা নিধনযজ্ঞ পরিচালনা করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ঘোষনায় সারা দিয়ে এ জেলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
২৫ মার্চের আগেই ছাত্রনেতা আবুল কাশেম, তপন চৌধুরী, রতন বিশ্বাস ও সামরিক বাহিনীর আশরাফের নেতৃত্বে দেবেন্দ্র কলেজ থেকে সংগৃহীত ২৫০ টি ইউটিসির জামি রাইফেল নিয়ে কলেজ মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করে। ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাকবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের খবর ওয়ারলেসের মাধ্যমে থানায় আসে। এখবর শোনার পর আওয়ামীলীগ ও ন্যাপ নেতারা রাতেই মহকুমা প্রশাসনের অফিসে এক সমাবেশ আহবান করে। সমাবেশ থেকে ক্যাপ্টেন (অবঃ) আব্দুল হালিম চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নেন। পাকবাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের আক্রমন ও ষড়যন্ত্রের প্রতিরোধে মুক্তিযোদ্ধারা ২ টি ব্যানারে কাজ করে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই পাকবাহিনীরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও ৭টি থানা দখল করে।
এরপর এদেশীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনীরা চালায় ধ্বংসযজ্ঞ। হরিরামপুরের দুর্গম পদ্মার চরাঞ্চলকে সুবিধাজনক স্থান হিসেবে বেছে নিয়ে বিপ্লবী পরিষদ ঘাটি ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে। আগষ্টের প্রথম দিকে ঘিওর থানা আক্রমনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধারা সর্বাত্নক মুক্তিযুদ্ধের শুভ সূচনা করে।
সিংগাইর থানার বায়রা নামকস্থানে ধলেশ্বরী নদীর উত্তর পাড় থেকে নৌকায় চলাচলকারী পাক বাহিনীর উপর ব্রাশফায়ার করলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে জেলার প্রায় সব থানা ত্যাগ করে পাকবাহিনী মহকুমা ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। জেলার সর্বত্রই মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রনে নিতে চেষ্টা করলে পাকহানাদাররা ১৩ ডিসেম্বর সকাল বেলা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এবং মানিকগঞ্জ সম্পূর্নরুপে হানাদার মুক্ত হয়। ১৩ ডিসেম্বর বিজয়ীবেশে মুক্তিযোদ্ধারা দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে সমবেত হন। আওয়ামীলীগ নেতা মাজহারুল হক চান মিয়ার সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।
মানিকগঞ্জে বিভিন্ন যুদ্ধে ৫৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ৯ জন মুক্তিযোদ্ধা পঙ্গু হয়ে যান। ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের বীরত্বের জন্য খেতাব প্রাপ্ত হন। খেতাব প্রাপ্তদের মধ্যে স্কোয়াডন লিডার (অবঃ) বদরুল আলম বীর উত্তম, শহীদ মাহফুজুর রহমান (বীর প্রতিক) ইব্রাহীম খান (বীর প্রতিক) এবং মোঃ আতাহার আলী (বীরপ্রতিক) বর্তমানে খেতাব প্রাপ্তদের মধ্যে বীর প্রতিক আতাহার আলী জীবিত আছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হোক আজকের প্রজন্ম এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এ বছরও উদযাপিত হবে ১৩ দিন ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা।