আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের পাঁচ বছরের দায়িত্বে কাজের তেমন সুযোগ না থাকলেও উপমন্ত্রীর পদমর্যাদাসহ তাদের সব দাবিই অপূর্ণ রয়ে গেল। র্পাঁচ বছর মেয়াদে জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ায় কাজের নুন্যতম স্বীকৃতি তেমন নেই। নির্বাচিত পরিষদ চেয়ারম্যানরা একরকম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বুকে পুষে চেয়ার ছেড়েছেন। সংশ্নিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, জেলা পরিষদের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে সরকারি দলের নেতাদের কিছু ক্ষেত্রে ‘পুনর্বাসন’ করার পাশাপাশি প্রশাসনের পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদেও ছিলেন।
চেয়ারম্যানদের মধ্যে সদ্যবিদায়ী কেউ কেউ বলেছেন, জেলা পরিষদের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীরা উপকৃত হলেও তারা দ্রুত নতুন নির্বাচন দাবি করেন। গত ৬ এপ্রিল জাতীয় সংসদে জেলা পরিষদ বিল পাস হয়। পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কারণে গত রোববার ৬১ জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে (উপসচিব) নতুন প্রশাসক না বসানো পর্যন্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত এ আমলারাই জেলা পরিষদের দায়িত্বে থাকবেন। যে কোনো ব্যক্তিকে ১৮০ দিনের জন্য প্রশাসক বসানোর সুযোগ রাখা হয় সংসদে পাস হওয়া এ আইনে। এ ছাড়াও মূল আইনে জেলা পরিষদের ভোটার তালিকা প্রণয়নের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলেও সংশোধিত আইনে নির্বাচন কমিশনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, জেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটার তালিকা নিয়ে আবারও জটিলতায় নির্বাচনও আটকে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা অনির্বাচিত প্রশাসক বসানোর সরকারের এই সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই আইনের সংশোধনের প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ একাধিক দলের সংসদ সদস্যরা প্রশাসক বসানোর প্রস্তাবকে সংবিধানবিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘অনির্বাচিত প্রশাসক মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা অসাংবিধানিক।’ তিনি আরও বলেন, “যে যুক্তিতে তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অসাংবিধানিক, একই যুক্তিতে স্থানীয় সরকারে ১৮০ দিনের জন্য অনির্বাচিত প্রশাসকও অসাংবিধানিক। কারণ সংবিধানের ৫৯(১) অনুচ্ছেদে বলা আছে- ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ একইভাবে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে আরও স্পষ্ট করে বলা আছে- ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র এবং প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হইবে।’ এর পরও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া কোনোভাবেই সংবিধানসম্মত নয়।”
স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিরাই এতে নিয়োগ পাবেন। প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা দায়িত্বে থাকবেন। নির্বাচনের জন্য নতুন ভোটার তালিকা জেলা প্রশাসকরা তৈরি করবেন। কারণ, এখানকার ভোটার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিরা হওয়ায় ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা সহজ।’ এদিকে সারাদেশের ৬১ জেলা পরিষদের সদস্যরা অনির্বাচিত প্রশাসক বসানোর তীব্র বিরোধিতা করে বলেছেন, তারা আশা করছেন দ্রুত সময়ে নির্বাচন হবে এবং জেলা পরিষদ পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে চলে আসবে। তাদের শঙ্কা, আইনে যে কোনো ব্যক্তিকে প্রশাসক বসানোর সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ জেলায় আমালদেরই প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে।
জেলা পরিষদের একাধিক চেয়ারম্যান বলেন, এটা আমলাদেরই কারসাজি। তারা জনপ্রতিনিধিদের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না। তারা যা খুশি তা করছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তা চেয়ারম্যানদের জন্য নিশ্চিত অপমানজনক।
ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাদেক কুরাইশী বলেন, ‘জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমলা। আবার যদি প্রশাসকও আমলা নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে পুরো জেলা পরিষদ আমলানির্ভর হয়ে যাবে। রাজনীতিবিদদের কোনো জায়গা থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘সীমিত বরাদ্দে জেলা পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা অনেক উন্নয়ন কাজ করেছে। চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা ও অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হলে জেলা পর্যায়ে আরও উন্নয়ন হতো।’
বিলুপ্ত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফোরামের সদস্য সচিব মহিউদ্দিন মহারাজ বলেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের পদমর্যাদা নির্ধারিত না থাকায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের বিভিন্ন কাজে দেখা দেয় সমন্বয়হীনতা। জাতীয়, সামাজিক বা সরকারি অনুষ্ঠানে তাদের পাশে বসতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়ার পর নতুন দায়িত্বভার গ্রহণকারী ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রামকৃষ্ণ বর্মণ বলেন, ‘স্বাভাবিক নিয়মেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা এখন জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পেয়েছেন। আগে আর্থিক ক্ষমতাটা যৌথ সইয়ে হতো।’
সিলেট জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা জেলা পরিষদের দায়িত্ব পালন করবেন। সে হিসেবে আমি দায়িত্ব বুঝে নিয়েছি।’
বিগত পাঁচ বছরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে অনেক স্থানেই সরকারি দলের বর্ষীয়ান নেতারা ছিলেন। তারা জানান, তারা যে প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেছেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
রা/চৌ